দীর্ঘ সময় পর সিরিয়ার রাস্তাঘাটে ফিরে এসেছে বাঁধহীন আনন্দ। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের জনজীবনে এমন দৃশ্য বহুদিন দেখা যায়নি। গত মঙ্গলবার দেশজুড়ে উৎসবমুখর এক পরিবেশ তৈরি হয়। যখন সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদ থেকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়া থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করছে’। সেই খবর শোনামাত্র উদ্দীপ্ত হয়ে পড়ে সিরিয়ার জনজীবন। যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিকে পুনর্গঠনের নতুন আশাবাদ তৈরি করে এই ঘোষণা।
সিরিয়ার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা কী কী
সিরিয়ার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার শুরু ১৯৭৯ সালে। সে বছর যুক্তরাষ্ট্র ‘সন্ত্রাসে পৃষ্ঠপোষকতা করা দেশ’ হিসেবে যে তালিকা তৈরি করে, তাতে প্রথম থেকেই ছিল দামেস্কের নাম।
এই তালিকায় নাম ওঠার অর্থ ছিল— মার্কিন সাহায্য বন্ধ, অস্ত্র বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা, আর মার্কিন ব্যাংকগুলোর সঙ্গে সিরীয় সরকার ও তাদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের আর্থিক লেনদেনের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ। পাশাপাশি, একাধিক সিরীয় সরকারি কর্মকর্তা ও প্রতিষ্ঠানের ওপরও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
১৯৯০-এর দশকে বিশ্ব রাজনীতির পালাবদলে সিরিয়া নতুনভাবে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে শুরু করে।
তবে ‘স্মিথ কলেজ’-এর মধ্যপ্রাচ্য অধ্যয়ন বিভাগের প্রধান স্টিফেন হেইডম্যানের মতে, হাফেজ আল-আসাদ ও তাঁর পুত্র বাশার আল-আসাদের শাসনামলে ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্পর্ক বরাবরই টানাপোড়েনের মধ্যে ছিল।
২০০৫ সালে মার্কিন কংগ্রেস ‘সিরিয়া জবাবদিহি আইন’ পাস করে। অভিযোগ ছিল—সিরিয়া তাদের ভূখণ্ড সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করতে দিচ্ছে। যারা ইরাক এবং পরে লেবাননের স্থিতিশীলতার হুমকি তৈরি করেছে।
এই আইনের আওতায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে সিরিয়ায় অধিকাংশ পণ্যের রপ্তানিতে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়, যদিও খাদ্য ও ওষুধ ছিল এর বাইরে। সিরিয়ার বিমান সংস্থাগুলোর যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশেও নিষেধাজ্ঞা জারি হয় এবং বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার আসে নিষেধাজ্ঞা।
তবে তখনো সিরিয়া থেকে পণ্য—এমনকি জ্বালানি তেল—আমদানি ও ব্যাংক লেনদেনের ওপর সরাসরি নিষেধাজ্ঞা ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগও তখন সিরিয়ায় নিষিদ্ধ ছিল না।
মূল পরিবর্তন আসে ২০১১ সালে, সিরিয়ায় গণবিপ্লব শুরু হলে এবং সরকারের কঠোর দমননীতি সামনে এলে। এর পরপরই নিষেধাজ্ঞার আওতা আরও বিস্তৃত করা হয়। এতে তেল-গ্যাস, বিমান চলাচল ও ব্যাংকিং খাতসহ কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ পণ্য ও প্রযুক্তির রপ্তানির ওপর কড়াকড়ি আরোপ করা হয়।
২০১৯ সালের শেষ দিকে আসে আরেক বড় ধাক্কা। ‘সিরিয়ার বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা আইন’, যা ‘কেইসার আইন’ নামে পরিচিত। কেইসার ছিলেন সিরীয় সরকারের এক সামরিক আলোকচিত্রী, যিনি সরকারের নির্যাতনে নিহত হাজারো বন্দির ছবি ফাঁস করে দেন।
স্টিফেন হেইডম্যানের মতে, এই আইন ছিল নিষেধাজ্ঞার ধারায় এক বড় মোড়। এই আইনের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র তাদের অবস্থান আরও কঠোর করে এবং ‘মাধ্যমিক নিষেধাজ্ঞা’ চালু করে, যার আওতায় সিরীয় সরকারের পাশাপাশি যেসব দেশ বা প্রতিষ্ঠান তাদের সঙ্গে লেনদেন করে, তারাও নিষেধাজ্ঞার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়।
কোন নিষেধাজ্ঞাগুলো প্রত্যাহার করা হবে এবং কবে?
সিরিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হচ্ছে—এমন ঘোষণা এলেও এখনো স্পষ্ট নয় কোন নিষেধাজ্ঞাগুলো তুলে নেওয়া হবে এবং কখন তুলে নেয়া হবে।
সিরিয়ার অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ড. কারম আশ শার বলছেন, বিষয়টি নিয়ে এখনও অনেক অনিশ্চয়তা রয়েছে। তার ভাষ্য, ট্রাম্প মঙ্গলবার রিয়াদে দেওয়া বক্তৃতায় ‘নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার’-এর কথা বলেননি, বরং ‘স্থগিত’ বা ‘মুলতবি’ করার কথা বলেছেন। এতে করে প্রকৃত অবস্থা নিয়ে ধোঁয়াশা থেকেই যাচ্ছে।
কারম আশ শারের মতে, এখনও এমন কিছু দাবি রয়েছে, যা সিরিয়ার পূরণ করতে হবে। এখানেই প্রশ্ন উঠছে—ট্রাম্প এই ঘোষণা দিলেন কেন? সিরিয়া কি এর বিনিময়ে কিছু দিয়েছে? যদি দিয়ে থাকে, সেটা কী?
বক্তৃতায় ট্রাম্প জানান, সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে আলোচনার পরই তিনি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। যুবরাজ তাকে নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি বিবেচনার আহ্বান জানান।
স্টিফেন হেইডম্যান মনে করেন, ট্রাম্পের এই বক্তব্য মূলত সৌদি নেতৃত্বের উদ্বেগের প্রতি এক ধরনের সদয় সাড়া। এটা নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক বার্তা বলেও জানান তিনি। তবে সবকিছু সুরাহা হবে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে গিয়ে কী করেন, এর ওপর ভিত্তি করেই।
যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাহী আদেশে আরোপিত নিষেধাজ্ঞাগুলো ট্রাম্প চাইলে প্রেসিডেন্ট হিসেবে একটি নির্বাহী আদেশের মাধ্যমেই তাৎক্ষণিকভাবে তুলে নিতে পারেন।
তবে যেসব নিষেধাজ্ঞা কংগ্রেসে আইন আকারে পাস হয়েছে, সেগুলো প্রত্যাহার করতে হলে কংগ্রেসে ভোটাভুটির প্রয়োজন হবে। ফলে এ প্রক্রিয়া হতে পারে দীর্ঘমেয়াদি।
‘সিজার আইন’—যেটির আওতায় সিরিয়ার সঙ্গে লেনদেনকারী তৃতীয় পক্ষের ওপরও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়—এটি কংগ্রেস অনুমোদিত নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পড়ে।
ড.কারম আশ শার মনে করেন, ট্রাম্প প্রশাসন চাইলে বাইডেন প্রশাসনের আমলে জারিকৃত একটি বিশেষ লাইসেন্সের মেয়াদ বাড়াতে পারে। ওই লাইসেন্সে কিছু নির্দিষ্ট অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে নিষেধাজ্ঞার বাইরে রাখা হয়েছিল। ভবিষ্যতে স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের আগে অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপ হিসেবে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার সিরিয়ার মানুষের জীবনে কী প্রভাব ফেলবে?
সিরিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্তের ঘোষণা আসার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দেশটির মুদ্রাবাজারে পরিবর্তনের হাওয়া লাগে। ডলারের বিপরীতে সিরিয়ান পাউন্ডের বিনিময় হার একলাফে ১১ হাজার থেকে নেমে আসে প্রায় ৬ হাজারে। যা স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়— সিরিয়ার জনগণের মধ্যে আশাবাদ বাড়ছে।
অর্থনীতি বিশ্লেষক ড. কারম আশ শার মনে করেন, এই পরিবর্তন মূলত মানসিক ও রাজনৈতিক প্রভাবের ফল। তবে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের প্রকৃত আর্থিক সুফল পেতে সময় লাগবে—সম্ভবত কয়েক মাস।
তার মতে, নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার সবচেয়ে বড় উপকার পাবে ব্যাংকিং খাত। এতদিন গৌণ নিষেধাজ্ঞার কারণে এমনকি অনেক সিরিয়ানও নিজেদের দেশের পুনর্গঠনে ভূমিকা রাখতে পারেননি। নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে এই অবরোধ ভাঙবে।
বহুবছরের নিষেধাজ্ঞা সিরিয়াকে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সিস্টেমে বাইরে ঠেলে দেয়। এতে শুধু দেশটির বাণিজ্য ও বিনিয়োগ নয়, অনেক সময় মানবিক সহায়তার কার্যক্রমও ব্যাহত হয়েছে।
স্টিফেন হেইডম্যানের বলেন, মার্কিন নিষেধাজ্ঞাগুলোই ছিল সিরিয়ার অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে আন্তর্জাতিক অংশগ্রহণের সবচেয়ে বড় বাধা।
নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে বিদেশি বিনিয়োগের দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যাবে। ফলে সিরিয়া আবার আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মানচিত্রে ফিরে আসতে পারবে। একইসঙ্গে, সৌদি আরব ও কাতারের মতো মিত্র দেশগুলোও দামেস্কে ত্রাণ ও সহায়তা পাঠাতে এগিয়ে আসবে বলে আশা করা যায়।
অন্য নিষেধাজ্ঞাগুলোর অবস্থা কী?
মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি সিরিয়া জাতিসংঘের কিছু নিষেধাজ্ঞারও আওতায় রয়েছে, যা মূলত হাইয়াত তাহরির আশ-শামকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করার সঙ্গে জড়িত। এই সংগঠনের নেতৃত্বে একসময় ছিলেন আহমাদ আশ শারা। যদিও চলতি বছরের শুরুতে সংগঠনটি নিজেদের বিলুপ্তির ঘোষণা দিয়েছে। তবে এখনো স্পষ্ট নয়—এই সন্ত্রাসবাদের তকমা সিরিয়ায় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সম্পৃক্ততার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে কি না।
এছাড়া রয়েছে ইউরোপীয় নিষেধাজ্ঞা, যা ২০১১ সালের পর থেকে ক্রমেই কঠোর হয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের আগেই ইউরোপীয় দেশগুলো সিরিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা শিথিল করতে উদ্যোগ নিয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন একটি ধাপে ধাপে এবং শর্তসাপেক্ষে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের কৌশল হাতে নিয়েছে—যেখানে প্রয়োজনে যেকোনো সময় সেগুলো আবার চালু করার সুযোগ থাকছে।
গত ফেব্রুয়ারিতে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন সিরিয়ার জ্বালানি ও পরিবহনসহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ খাতে নিষেধাজ্ঞা সাময়িকভাবে স্থগিত করে। একই সঙ্গে, কয়েকটি সিরিয়ান ব্যাংকের ওপর জারি করা অর্থ ও সম্পদ জব্দের নিষেধাজ্ঞাও তুলে নেওয়া হয়। এমনকি সিরিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অর্থ সরবরাহ এবং দেশটির সঙ্গে ব্যাংকিং লেনদেনে কিছুটা ছাড়ও দেওয়া হয়েছে।
যুক্তরাজ্যও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতোই উদ্যোগ নিয়েছে।
নিষেধাজ্ঞা শিথিলের ফলে দেশের অর্থনীতি এবং মানুষের জীবনমান কিছুটা স্বস্তি পাবে—এটাই এখন সিরিয়ার জনগণের জন্য বড় আশা। যদিও পুরো অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে এখনও অনেক সময় লাগবে, তবু নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারই এই দীর্ঘ পথচলার প্রথম ধাপ বলে মনে করা হচ্ছে।
সূত্র: ইলাফ