মধ্যপ্রাচ্য পত্রিকা

মধ্যপ্রাচ্য অর্ডার করতে ক্লিক করুন

অবশেষে আত্মসমর্পণে কেন বাধ্য হলো ইসরায়েল?

শেষমেশ আত্মসমর্পণে কেন বাধ্য হলো ইসরায়েল?
শেষমেশ আত্মসমর্পণে কেন বাধ্য হলো ইসরায়েল?। ছবি : আল মায়াদিন

গাজার আকাশে এখন শান্তির ছায়া, থেমে গেছে ট্যাংকের গর্জন, কামানের শব্দ আর যুদ্ধবিমানের গুমগুম আওয়াজ। দীর্ঘদিন ধরে চলা রক্তক্ষয়ী সংঘাত শেষে নতুন এক বাস্তবতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে—ইসরায়েল নামের রাষ্ট্রটির ভবিষ্যৎ আর কখনো তার অতীতের মতো হবে না।

দীর্ঘ ১৫ মাসের সংঘাত আর একগুঁয়েমি শেষে অবশেষে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে নেতানিয়াহু ও তার উগ্রপন্থি সরকার। ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক চাপ এবং অভ্যন্তরীণ জটিল পরিস্থিতি তাদের বাধ্য করেছে গাজার প্রতিরোধ আন্দোলনের ন্যায্য দাবিগুলো মেনে নিতে। অথচ, এতদিন তারা এসব দাবি বারবার প্রত্যাখ্যান করে বলেছিল, যতদিন তাদের সব লক্ষ্য পূরণ না হবে, ততদিন যুদ্ধ থামবে না।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর রাতে যুদ্ধ শুরু হলেও পরের বছর ২ মে গাজার প্রতিরোধ আন্দোলন একটি সমাধানের প্রস্তাব দেয়। এই প্রস্তাব যুদ্ধবিরতির পথ খুলে দিতে পারত। এতে প্রতিরোধ আন্দোলন বড় ধরনের নমনীয়তা দেখিয়েছিল, বিশেষ করে গাজার অবরুদ্ধ জনগণের ভয়াবহ পরিস্থিতি বিবেচনায়।

তবে সেই প্রস্তাব নেতানিয়াহু সরকার সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রসহ আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতাকারীরা প্রস্তাবটির পক্ষে ছিল। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রও একে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট সমাধানের একটি কার্যকর পদক্ষেপ হিসেবে দেখেছিল।

এরপর সংঘাত আরও ভয়াবহ রূপ নেয়। ইসরায়েলের হামলায় ৫০ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি শহিদ হয়, যাদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু। ধ্বংস হয় অসংখ্য অবকাঠামো। কিন্তু গাজার জনগণের দুর্দশা উপেক্ষা করেই নেতানিয়াহু সরকার প্রতিরোধ আন্দোলনের প্রস্তাব নাকচ করে দেয়।

তবে নাটকীয়ভাবে পরিস্থিতি পাল্টে যায় গত তিন সপ্তাহে। আন্তর্জাতিক চাপ এবং অভ্যন্তরীণ সংকটে দিশেহারা নেতানিয়াহু তার কঠোর অবস্থান থেকে সরে আসতে বাধ্য হন। যুদ্ধের কূটনৈতিক সমাধানের জন্য পথ খুঁজতে ইসরায়েলকে এখন গাজার প্রতিরোধ আন্দোলনের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।

প্রশ্ন হলো, কী এমন ঘটল যে নেতানিয়াহু হঠাৎ করে পূর্বে প্রত্যাখ্যাত একটি চুক্তি মেনে নিতে বাধ্য হলেন? চারটি বড় কারণকে এ পরিবর্তনের পেছনে চিহ্নিত করা যেতে পারে।

প্রথমত, গাজার প্রতিরোধ আন্দোলনের দৃঢ়তা। দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক মহলের চাপ, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের। তৃতীয়ত, ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং চতুর্থত, দীর্ঘ যুদ্ধের ফলে ইসরায়েলের সামরিক দুর্বলতা।

যদিও নেতানিয়াহু এটিকে একটি অস্থায়ী সমঝোতা হিসেবে উল্লেখ করছেন, দাবি করছেন তার সেনাবাহিনী প্রয়োজনে আবার যুদ্ধ শুরুর জন্য প্রস্তুত। তবে বাস্তবতা হলো, এই যুদ্ধবিরতি ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ সংকট এবং আন্তর্জাতিক চাপের পষ্ট ফলাফল।

নতুন সমীকরণে ইসরায়েলের পিছু হটা

নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতে একটি ভিন্ন পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। যদিও ট্রাম্প প্রকাশ্যে ইসরায়েলের প্রতি তার সমর্থন ঘোষণা করেছেন এবং নিজেকে ইসরায়েলের ‘সেরা বন্ধু’ বলে দাবি করেছেন কিন্তু তার অবস্থান আগের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের থেকে আলাদা। বাইডেন একাধিকবার গাজায় সংঘাত বন্ধে সমাধানের আহ্বান জানিয়েছিলেন, তবে তিনি ইসরায়েলকে এই প্রস্তাব মানতে বাধ্য করতে পারেননি। এর পেছনে ছিল নির্বাচনী রাজনীতি, ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টাদের চাপ এবং বিশেষত ইসরায়েলের প্রতি জোরালো সমর্থনকারী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের মতো প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ভূমিকা।

বিপরীতে ট্রাম্প প্রশাসনের মনোযোগ ছিল অন্যত্র—চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নানা জটিল ইস্যু। এ অবস্থায় নেতানিয়াহুর কাছে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, গাজায় চলমান যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করলে নতুন মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন তৈরি হতে পারে। এমন দ্বন্দ্ব এড়ানো নেতানিয়াহুর জন্য জরুরি হয়ে পড়ে, বিশেষ করে যখন তার নিজের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ দুর্বল অবস্থানে ছিল। পাশাপাশি তার বিরুদ্ধে বেশ কিছু আইনি মামলা ঝুলে ছিল।

ইসরায়েলের সামরিক প্রতিষ্ঠানের অবস্থান

ইসরায়েলের সামরিক প্রতিষ্ঠান সবসময়ই দেশটির নীতিনির্ধারণে প্রভাবশালী। দেশটির বিশাল বাজেটের একটি বড় অংশই এই প্রতিষ্ঠানের দখলে। শুধু দেশের সুরক্ষায় নয়, সারা বিশ্বের ইহুদি জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও এর দায়িত্ব। তবে সাম্প্রতিক যুদ্ধ পরিস্থিতিতে এই প্রতিষ্ঠান নিজেই ব্যর্থতার চাপ অনুভব করছে।

গত ৭ অক্টোবরের হামলার সময় যেসব ব্যর্থতা সামনে এসেছে, তা থেকে বাঁচতে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইয়োয়াভ গ্যালান্ট এবং সেনাপ্রধান হ্যারেৎস হালেভি যুদ্ধবিরতির পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। তারা চেয়েছেন অর্জিত সাফল্য নিয়ে যুদ্ধ থামাতে, যাতে সামরিক প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা রক্ষা করা যায়। সাম্প্রতিক সময়ে ইসরায়েলি সামরিক শক্তির যে পরাজয়ের ছবি ফুটে উঠেছে, তা দেশটির ইতিহাসে নজিরবিহীন। একসময়ের ‘অপরাজেয়’ হিসেবে পরিচিত ইসরায়েলি সেনাবাহিনী আজ ব্যর্থতার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে বিশ্বজুড়ে।

যুদ্ধক্ষেত্রে অচলাবস্থা

গাজায় ইসরায়েলের স্থল অভিযান যখন নবম মাসে পা রাখে এবং রাফা শহরে আক্রমণের দুই মাস পর, যুদ্ধক্ষেত্রে কার্যত অচলাবস্থা দেখা দেয়। ইসরায়েলি বাহিনী ঘরবাড়ি ও অবকাঠামো ধ্বংস করা ছাড়া তেমন কোনো কার্যকর সামরিক সাফল্য অর্জন করতে পারেনি।

অন্যদিকে, গাজার প্রতিরোধ বাহিনী প্রতিটি অঞ্চলে সাহসিকতার সঙ্গে প্রতিরোধ গড়ে তুলে। তারা ইসরায়েলের শহর ও বসতিগুলোতে লাগাতার রকেট হামলা চালিয়েছে। ইসরায়েলের সেনাবাহিনী এই পরিস্থিতি সামলাতে ব্যর্থ হয়েছে, আর এই ব্যর্থতা তাদের ভেতরে হতাশা তৈরি করেছে ক্রমবর্ধমানভাবে।

পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞও তাদের ব্যর্থতা আড়াল করতে পারেনি। বরং এই যুদ্ধ ইসরায়েলের সামরিক শক্তির মিথটিকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে।

গাজায় ইসরায়েলের বিপর্যয়: ভবিষ্যৎ কী সংকটে?

গাজা উপত্যকায় দীর্ঘদিনের সংঘাত ইসরায়েলের জন্য এক অভূতপূর্ব বিপর্যয় ডেকে এনেছে। গত এক বছরে এই আগ্রাসনে ইসরায়েলের যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তা তাদের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ধাক্কা। বিশেষত, উত্তর গাজার লড়াই ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর জন্য পরিণত হয়েছে এক দুঃস্বপ্নে।

ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, এই সংঘর্ষে হতাহতের সংখ্যা বিপজ্জনকভাবে বেড়েছে। শুধু জাবালিয়া, বেইত লাহিয়া ও বেইত হানুনের মতো এলাকায়ই প্রায় ৫০ জন ইসরায়েলি সেনা কর্মকর্তা নিহত হয়েছে। প্রতিরোধ আন্দোলনের দাবি, প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়েও অনেক বেশি। তীব্র বোমা বর্ষণ, ড্রোন হামলা ও ভারী অস্ত্র ব্যবহারের পরও ইসরায়েল উল্লেখযোগ্য কোনো সামরিক সাফল্য অর্জন করতে পারেনি।

সামরিক ও রাজনৈতিক চাপ

গাজায় এই ব্যর্থতা ইসরায়েলের সামরিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করেছে। উত্তর গাজায় সংঘর্ষে হতাহতের সংখ্যা বাড়তে থাকায় সেনাবাহিনীর ইউনিটগুলো পালাক্রমে সরিয়ে নেওয়া হয়। নতুন ইউনিট মোতায়েন করেও সেনাবাহিনী তাদের দুর্বলতা ঢাকতে পারেনি।

অন্যদিকে, ইসরায়েলের রাজনীতিতেও সংকট ঘনীভূত হচ্ছে পাল্লা দিয়ে। জনগণের ক্রমবর্ধমান ক্ষোভ, নেতৃত্বের ব্যর্থতা এবং আন্তর্জাতিক সমালোচনা তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎকে আরও অনিশ্চিত করে তুলেছে।

ইসরায়েলের ভবিষ্যৎ কি আগের মতো থাকবে?

যুদ্ধ থেমে গেলেও ইসরায়েলের ভবিষ্যৎ কি তাদের অতীতের মতো স্থিতিশীল থাকবে, এখন এটাই বড় প্রশ্ন। বিশ্লেষকদের মতে, ইসরায়েল এখন এক গভীর সংকটাপন্ন অবস্থায় আছে। আমেরিকা এবং আঞ্চলিক সমর্থনের ওপর নির্ভর করলেও ইসরায়েলের ‘অবৈধ রাষ্ট্র’ হিসেবে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে।

২০০৫ সালে, ফিলিস্তিনি প্রতিরোধের চাপে গাজা থেকে একতরফাভাবে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল ইসরায়েল। সেসময় তারা নেতজারিমসহ ২০টি বসতি ছেড়ে দিয়েছিল। আজ, প্রতিরোধ শক্তি আরও সুসংগঠিত ও শক্তিশালী। ফলে, ভবিষ্যতে তাদের শুধু গাজা কিংবা পশ্চিম তীর নয়, নিজেদের অভ্যন্তরীণ শহরগুলো থেকেও সরে যাওয়ার দিন ঘনিয়ে আসছে।

বলা হয়, ইতিহাসের প্রতিটি দখলদার শক্তির পতনের সময় আসে। বর্তমান পরিস্থিতি সেই ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিচ্ছে। যদিও আজকের পরিস্থিতি দেখে কেউ বলতে পারে, ইসরায়েলের শক্তি অবিনশ্বর। তবে সময় প্রমাণ করবে, এই শক্তি ক্ষয়িষ্ণু এবং ধ্বংসশীল।

ইসরায়েলের নেতারা যতই শক্তিশালী রাষ্ট্রের দাবি করুক না কেন, বাস্তবতা হলো, তাদের পতন অনিবার্য। ফিলিস্তিনের জনগণের প্রতি দীর্ঘদিনের অন্যায়, দমনপীড়ন এবং যুদ্ধাপরাধের জন্য তাদের চড়া মূল্য দিতে হবে। সময়ের পালাবদল তাদের এই দখলদার প্রকল্পের পরিসমাপ্তি ঘটাবে।

মধ্যপ্রাচ্য পত্রিকা