আল আজহার ইউনিভার্সিটিতে নার্সিং পড়াকাল থেকেই আল-শিফা হসপিটালে কাজ করার ইচ্ছা ছিল। এটি ছিল আমার স্বপ্ন। আল-শিফা ছিল গাজার সবচেয়ে বড় ও স্বনামধন্য হাসপাতাল। ফিলিস্তিনের সেরা ডাক্তার ও নার্সরা সেখানে কাজ করেছেন। এমনকি বিদেশি বিভিন্ন মেডিক্যাল মিশনও সেখানে আসত। তারা নানান ধরণের ট্রেইনিং প্রদান করত।
গাজার সর্বস্তরের জনগণই এই আল-শিফায় চিকিৎসা সেবা নিয়েছেন। হাসপাতালের নামই তো শিফা বা আরোগ্য। নামের মতো এটি সত্যিই ছিল ফিলিস্তিনের আরোগ্যস্থল।
২০২০ সনে আমি নার্সিং পাশ করি। প্রথমে প্রাইভেট জব খুঁজতে থাকি। খণ্ডকালীন কিছু কাজবাজও করি। অতপর আমি ভলান্টিয়ার নার্স হিসেবে আল-শিফায় যুক্ত হই।
ইমার্জেন্সি বিভাগে কাজ করতাম। সময়টি ছিল দুর্দান্ত। প্রতিদিনিই আগ্রহ ও উদ্দীপনা নিয়ে কাজে যেতাম। আকর্ণ বিস্তৃত হাসি দিয়ে রোগীদের বরণ করে নিতাম। এই হাসি দিয়ে একটু হলেও তাদের কষ্ট লাঘবের চেষ্টা করতাম। শুকরিয়া জানিয়ে রোগীরা যখন দোয়া করতেন, আমার তনুমন তখন খলবল করে উঠত।
ইমার্জেন্সি বিভাগে আমরা মোট ৮০ জন নার্স কাজ করতাম—নারী-পুরুষ মিলে। আমাদের মাঝে ছিল সৌহার্দ। আমার কয়েকজন পুরাতন বন্ধুও এই বিভাগে কাজ করত। তাদের মধ্যে একজন ছিল ‘আলাহ’। আমাদের শিফট ছিল একই সাথে। কাজের বাহিরে আমরা একসাথে কফি খেতে যেতাম। সে খুবই চমৎকার একটি মেয়ে ছিল। তার হৃদয় ছিল কোমল। সবার কাছে সে ছিল প্রিয়পাত্র।
সময়টা তখন সত্যিই দারুন ছিল। সহকর্মীদের মাঝে ছিল বন্ধুত্ব ও সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক। ফলে সকল সংকটই আমি কাটিয়ে উঠতে পারতাম। কিন্তু যুদ্ধটা তখনই শুরু হলো। প্রথম দিন থেকেই হাসপাতালে নিহত-আহতের ‘রক্তাক্ত ভিড়’ লেগে গেল। প্রথম শিফট শেষ করে নার্স রুমে গিয়ে আমি হুহু করে কেঁদে উঠলাম। সারাটা সময় শুধু রক্ত দেখেছি। আর শুনেছি আহতদের আর্তচিৎকার। পুরো একটা ঘণ্টা আমি ফুঁপিয়ে কাঁদলাম।
মাত্র কদিনের ব্যবধানেই হাসপাতালে হাজারেরও বেশি আহত ও নিহত মানুষ আসে। একটু পরপরই কেবল আহতদের আনা হচ্ছিল। আর আমরা আগেরও চেয়ে অধিক পরিশ্রমে তাদের জীবন বাঁচানোর জন্য লড়াই করে যাচ্ছিলাম।
আমি কখনো ভাবিইনি যে, এই বীভৎসতা মাসাধিক চলবে। কিন্তু……
কদিন পরের কথা। দখলদার আর্মিরা আমার পরিবারকে ডেকে পাঠাল। আমাদেরকে গাজা ছেড়ে যেতে বলল। আমি তখন দোটানায় পড়ে গেলাম। এমন বীভৎস সময়ে আমি কি পরিবারের সাথে থাকব নাকি থাকব আল শিফার রোগীদের সাথে—আমার উপস্থিতি যাদের খুবই প্রয়োজন? আমি থেকে যাবারই সিদ্ধান্ত নিলাম!
আমার পরিবারকে বিদায় জানালাম। তারা দক্ষিণে রাফার দিকে চলে গেলেন। আর আমি আল-শিফা হসপিটালে রয়ে গেলোম। এটিই এখন আমার সেকেন্ড হোম। আমার বান্ধবী আলাহও রয়ে গেল। আমরা একে অন্যের মনের জোর বাড়াতাম। সান্ত্বনা দিতাম একে অপরকে।
নভেম্বরের শুরুর কথা। দখলদার আর্মিরা হাসপাতাল খালি করতে বলল। ওরা অবরোধ করে রাখল। চিকিৎসা সামগ্রীও কমে যেতে লাগল। জেনারেটরের ফুয়েলও দ্রুত ফুরিয়ে আসছিল। বিদ্যুত দিয়েই তো সংকটকালীন মেশিনপত্র চলত!
এক সময় আমাদের ফুয়েল ও অক্সিজেন ফুরিয়ে গেল। তখন আমরা অপুষ্ট নবজাতকদের নিয়ে সংকটে পড়ে গেলাম। তাদেরকে আর ‘বিশেষ কেয়ারে’ রাখা যাচ্ছিল না। সম্ভত এটিই ছিল সবচেয়ে মর্মান্তিক সময়। আমরা তাদেরকে একটি অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে রাখলাম। তাদেরকে উষ্ণ রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম। তারা শ্বাস নিতে পারছিল না। অথচ আমাদের কাছে অক্সিজেনও নেই। কী করুণ দৃশ্য!
সেই সময়ে আমরা আটটি নিষ্পাপ শিশুকে হারালাম। আমার পষ্ট মনে আছে, ওই নিষ্পাপ মুখগুলোর কথা ভেবে কান্নায় আমি ভেঙে পড়েছিলাম।
১৫ই নভেম্বর। দখলদার সৈন্যরা হাসপাতাল ভবনে অভিযান চালাল। এই আক্রমণে আমরা নির্বাক হয়ে গেলাম। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী জরুরি সেবা হিসেবে হাসপাতাল নিরাপদ থাকার কথা। কিন্তু সেই আইনও দখলদার সৈন্যদের সামনে নিথর হয়ে রইল।
অভিযানের ঠিক কিছুক্ষণ আগে কর্তৃপক্ষ আমাদের জানালেন যে, তারা একটি কল পেয়েছেন। দখলদার ইসরাইলি সৈন্যরা হাসপাতাল ভবনে অভিযান চালাবে। আমরা দ্রুত ইমার্জেন্সি ভবনের গেইট লাগিয়ে দিলাম। নার্সিং ডেস্কের চারিপাশে আমরা একত্রিত হলাম। আমরা সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ়।
পরের দিন দখলদার সৈন্যরা হাসপাতালের বাহিরে জড়ো হলো। আমরা বেরুতে পারছিলাম না। চিকিৎসার সরঞ্জাম ছিলই না বলতে গেলে। আমাদের কাছে যা ছিল, তা দিয়েই রোগীদের চিকিৎসা দিয়ে যাবার প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম।
আমাদের কাছে সামান্য দানাপানিও ছিল না। মনে পড়ে, আমার মাথা ভোঁ ভোঁ করছিল। প্রায় মূর্ছাই যাচ্ছিলাম। কারণ টানা তিনটা দিন একটা দানাও পেটে পড়েনি। দখলদারদের অভিযানকালেও আমরা কজন রোগীকে হারালাম।
১৮ই নভেম্বর। তখন আশ-শিফার পরিচালক ছিলেন ডক্টর মুহাম্মদ আবু সালমিয়্যাহ। তিনি আমাদের ডেকে বললেন, ‘দখলদাররা পুরো হাসপাতাল ভবন খালি করার আদেশ করেছে।,
আমার হাতে সুযোগ থাকলে, আমি অবশ্যই থেকে যেতাম। কিন্তু দখলদাররা দ্বিতীয় কোনো অপশনই রাখেনি।
আমরা ছিলাম কয়েক হাজার ডাক্তার ও নার্স। আমাদেরকে জোর করে বের করে দেয়া হলো। রোগীদেরও বের করে দিল। ডজন দুয়েক স্টাফকে কেবল থাকতে দিল। কারণ কয়েকজন শয্যাশায়ী রোগী ছিলেন। তাদেরকে সরানো যাচ্ছিল না। ডক্টর আবু সালমিয়্যাহও থেকে গিয়েছিলেন। তার কদিন পরই তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। পরবর্তী সাতটা মাস তাকে গুম করে রাখা হয়েছিল।
আমি ও আরও কয়েক ডজন সহকর্মী দক্ষিণ দিকে রওয়ানা দিলাম—দখলদারদের আদেশ অনুযায়ী। আমার বান্ধবী আলাহ ও আরও কজন দখলদারদের আদেশ অমান্য করল। তারা উত্তরে তাদের পরিবারের কাছে চলে গেল। মাইলের পর মাইল আমরা হেঁটে গেলাম। পথের মাঝে দখলদারদের একাধিক চেকপোস্ট ছিল। সেখানেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। অবশেষে পথিমধ্যে একটি গাধার বাহন পেয়েছিলাম। সেটি আমাদেরকে কিছু দূর পৌঁছে দিয়েছিল।
অবশেষে রাফায় পৌঁছালাম। আমার পরিবারকে দেখতে পেয়ে যারপরনাই আনন্দিত হলাম। সেখানেও ছিল কান্নাকাটির রোল ও সামান্য স্বস্তি। তবে পরিবারের সাথে থাকার আনন্দ বিষাদ হয়ে উঠল মর্মান্তিক সংবাদটি পেয়ে।
আলাহর পরিবার থাকত ‘বাইত লাহিয়্যাহয়’। আলাহ সেখানে গিয়েছিল। ওর পরিবার সেখানে একটি স্কুলে আশ্রয় নিয়েছিল। একদিন আলাহ ও তার ভাই তাদের পরিত্যাক্ত বাড়িতে কিছু সামানপত্র আনতে গিয়েছিল। আর তখনই দখলদারদের মিসাইল এসে আঘাত হানে। সেখানেই আমার বান্ধবী ও তার ভাই শাহাদাত বরণ করেন।
ওর মৃত্যুর খবর আমাকে প্রবল ঝাঁকুনি দিয়েছিল। ওর মৃত্যুর একটি বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু এখনো ওর বিচ্ছেদ আমাকে কাঁদায়। সে ছিল আমার দেখা অন্যতম মিষ্টি মেয়ে। যে অন্যদের সাহায্য করে আনন্দ পেত। আমার কঠিন সময়ে যে আমার সহায় হয়ে দাঁড়াত।
মার্চে দখলদার সৈন্যরা আবার আল-শিফায় আসে। পুরো হাসপাতালে চিরুনি অভিযান চালায়। হাসপাতালে ঢুকেই মানুষ হত্যা করে। হাসপাতাল কমপ্লেক্সের একটি ভবনও তারা ছাড়েনি। হয় জ্বালিয়ে দিয়েছে আর নয়ত করেছে তছনছ। তাদের ধ্বংসলীলার কারণে সেবাকেন্দ্র আল-শিফা এখন একটি সুনসান গোরস্তান হয়ে গেছে।
আমি জানি না, হাসপাতালটির চেহারা দেখলে আমার কেমন লাগবে। এটি ছিল আমার কর্মজীবনের সবচেয়ে দারুণ জায়গা। এখানে আমার সহকর্মীদের সঙ্গে মিষ্টিমধুর মুহূর্ত কাটিয়েছি। সেই জায়গা এখন মৃত্যুপুরী হয়ে আছে। এটি দেখে আমার কেমন লাগবে আমি জানি। আমি এখন আবেগশূন্য এক জড় পাথর যেন!
আজ এক বছরের বেশি সময় ধরে আমি আমার কর্মস্থল হারিয়েছি। আমি এখন একটি তাঁবুতে থাকি। তাঁবুর একটি ক্লিনিকে সেবা প্রদান করি। আমার ভবিষ্যত, না আমাদের ভবিষ্যত এখন অনিশ্চিত। তবে এই নতুন বছরে আমি আমার ও আমাদের আল-শিফাকে আবারও সেই মুখর ও চঞ্চল দেখতে চাই।
আল জাজিরা ইংরেজি তে প্রকাশিত হাদিল আওয়াদের আর্টিকেল থেকে অনুবাদ করেছেন ইমরান হোসাইন নাঈম